‘যুগবাণী‘ প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক জাতীয় শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুগবাণী প্রবন্ধে “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়” শীর্ষক এক প্রবন্ধে শিক্ষার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা চাই আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমন হউক যাহা আমাদের জীবনী শক্তিতে ক্রমেই সজাগ,জীবন্ত করিয়া তুলিবে।যে শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা
নজরুল ইসলাম তার শিক্ষা চিন্তায় সর্বদা জাতপাত, ধর্মীয়গোঁড়ামি, অস্পর্শকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গেছেন। “গাহি সাম্যের গান”শিক্ষা সহজীকরণ শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সযত্মে সুদ্রে দেয়া ও শিক্ষকদের ভুল গুলো পরিহার করে নেয়া ও অপরাধ থাকলে সেটাকে ক্ষমার অযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।এছাড়াও নারী পুরুষ উভয়ের জন্য শিক্ষার সম অধিকার বলেছেন
রবীন্দ্র যুগের ও রবীন্দ্র উত্তর কালের সবচেয়ে সফল ও বিস্ময়কর ছিলেন কাব্যিক, গীতিকার, গল্পকার ও দার্শনিক কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।বাংলাদেশে জাতীয় কবি এবং অভিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ দর্শন ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ট ব্যক্তিত্ব।
তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে “বিদ্রোহী কবি” ও আধুনিক বাংলা গানের জগতে “বুলবুল” নামে খ্যাত। আমরা সাধারন বাঙ্গালীগন কাজী নজরুল ইসলাম কে চিনি একজন সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার,কাব্যিক ইত্যাদি ব্যক্তিত্ব রুপে।কিন্তু এই সব ব্যক্তি প্রতিভা ছাড়াও তার ছিল দার্শনিক চিন্তা ভাবনা ও ধ্যান ধারনা।
যা আমরা অনেকটায় অবগত নই। আজ এই বিষয়ে সামান্যতম আলোকপাতের চেষ্টা করছি।কাজী নজরুলের তার বিদ্রোহী কবিতাই বারংবার উচ্চারিত হয়েছে ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে হুংকার। তিনি সর্বদা জাতপাত, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অস্পর্শকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গেছেন। “গাহি সাম্যের গান”
তিনি সবসময় সাম্যের কথা বলেছেন।নারী পুরুষ,ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্দ্ধে এসে এক সঙ্গে থাকার কথা বলেছেন।যেটা সামাজিক দর্শনের মূল মন্ত্র।জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুগবাণীর “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়” শীর্ষক এক প্রবন্ধে শিক্ষার উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা চাই আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমন হউক যাহা আমাদের জীবনী শক্তিতে ক্রমেই সজাগ,জীবন্ত করিয়া তুলিবে।যে শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা।‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসাবে ‘ডাংপিটে ছেলে বরং অনেক ভাল।কারন পূর্বোক্ত নিরীহ জীবরুপী ছেলেদের ‘জান’ থাকেনা; আর যাহার জান নাই,সে মর্দা দিয়ে কোন কাজই হয়না আর হইবেও না।এই দুই শক্তিকে প্রান শক্তি আর কর্ম শক্তিকে একত্রীভূত করাই যেন আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়।”(নজরুন রচনাবলী,১ম খন্ড, সম্পাঃ আবদুল কাদির,বাংলা একাডেমী,১৯৯৬,পৃষ্টাঃ৮৪৪)(প্রবন্ধ,জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
আমারা দেখেছি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা রাধাকৃষ্ণন কমিশন উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার মূল লক্ষ্য যোগ্য নেতৃত্ব বা জাতীয় নেৃতত্বের কথা স্বীকার করেছেন।আর ঠিক একই কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে নজরুলের “সত্য শিক্ষা” সার্থক প্রবন্ধে। সেখানে তিনি বলেছেন-
“এই শোভাযাত্রার দূর্মদ অগ্রযাত্রী আমাদের যে কিশোর আর তরুণের দল, সর্বাগ্রে তাহাদিগেরই অন্তরে বাহিরে ‘আজাদীর’ নেশা জমাইয়া তুলিতে হিবে।কারন ইহাদের ন্ত্যৃ-বিদ্রোহে অলস ভীরূ জীবন পথ যাত্রীর বুকে সাহস সঞ্চার হিবে।আমরা কিন্তু আমাদের এই উন্মুক্ত উদার প্রান গুলির চারপাশে নিত্য বন্ধন বাধা সৃজন করিয়া তাহাদিগের উচ্ছল গতিকে অচল করিতেছে।” কবি নজরুল ইসলাম ‘জাতীয় শিক্ষা’ প্রবন্ধে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যে কথা বলেছেন,তা এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।তিনি বলেছেন-“এখন যে পদ্ধতিতে জাতীয় শিক্ষা আমাদের ভবিষৎ আশা – ভরসার স্থল নব উদ্ভাবিত জাতীয় বিদ্যালয়ে দেওয়া হইতেছে,তাহাও ঠিক ঐ রকম বিলিতি শিক্ষায় ট্রেড মার্ক উঠাইয়া,‘স্বদেশী’ মার্কা লাগাইয়া দেওয়ার মত।”অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন,আধুনিক যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে, তা আমাদের নয়।আমরা শুধু দেশীয় ট্রেড মার্ক লাগিয়ে আমাদের বলে চালিয়ে দেই।দার্শনিক নজরুলের মতে এতে শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখতে পারছে না।শুধুমাত্র রাশি রাশি বইয়ের সাগরে তাদেরকে চুবিয়ে শিক্ষিত করা হয়।এতে শিক্ষিত অধ্যাপক নয়,তৈরী হচ্ছে কাঁচা আধ্যাপক।এই প্রসঙ্গে তিনি ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে বলেছেন-
“এই জাতীয় বিদ্যালয়ে কাঁচা কাঁচা অধ্যাপক নিয়োগ লইয়া যে ব্যাপার চলিতেছে তাহা হাজার চেষ্টা করিলেও চাপা দেওয়া যাইবেনা;মাছ দিয়ে শাক ঢাকা যায়না। কাঁচা অধ্যাপক মানে বয়সে কাঁচা নয়, বিদ্যায় কাঁচা।”
নজরুল দর্শনে তৎকালিন শিক্ষা ব্যবস্থায় যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক।উপযুক্ত শিক্ষিত হতে গেলে শিক্ষার্থীর তৎপর ও কাজের প্রতি বিশ্বাষ থাকতে হবে,যা বিবেকানন্দও বলেছেন।
অন্তনিহিত স্বত্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। নজরুল দর্শনে একটা বিষয় খুবই গুরুত্ব পূর্ণ,তা হল শিক্ষকদের সম্পর্কে তার ধারনা।তিনি মনে করেন যে শিক্ষক হবেন এমন যে শিক্ষার্থীর ভুল গুলিকে সযত্মে শুধরে দিবেন।আর শিক্ষার্থীরা ভূল করবেই,তাদের জোর করে শেখাবেন না।তারা ভুল করার মধ্যদিয়ে শিক্ষা নেবে।
তবে যদি একই ভাবে সমস্ত শিক্ষক কূল যে সব কিছুই জানবেন তা নয়,কারন “মুনিনাঞ্চ মতিভ্রমঃ” তাদেরও ভুলের মধ্যদিয়ে শিক্ষা নিতে হবে।তবে যদি কোন শিক্ষক ইচ্ছাকৃত ভূল করেন,তাবে তাকে কখনই ক্ষমা করা যাবে না।
জাতীয় বিদ্যালয় প্রবন্ধে তার এই কথাই ধ্বনিত হয়েছে।তিনি জাতীয় বিদ্যালয় প্রবন্ধে আর একটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।তিনি দেখেছেন শিক্ষার নামে এক শ্রেনী অসাধু শিক্ষক রা শিক্ষা কে ব্যবসায় পরিণত করেছেন।এই ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ আছে।তারা শিক্ষা কে পণ্য হিসাবে বিক্রি করছে।শিক্ষা একটি পবিত্র উপহার, তাকে নিয়ে এই ছেলে খেলা কে তিনি কক্ষনই সহমত দেননি।তিনি দৃপ্ত কন্ঠে এর প্রবল সমালোচনা করে বলেছেন-“প্রথমে কোন বড় কাজ করিতে গেলে অনেক রকম ভ্রম প্রমাদ হওয়া স্বাভাবিক জানি,এবং তাহাকে ক্ষমা করিতেও পারা যায় যদি জানি যে তাহারা জানিয়া শুনিয়া ভূল করিতেছেন বা জাতীয় শিক্ষা রুপ পবিত্র জিনিসের নামেও নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধির পথ খুঁজেতেছেন,তাহা হইলে হাজার অপ্রিয় হইলেও আমাদিগকে তাহা লইয়া আলোচনা করিতে হইবে।পবিত্র কোন জিনিসে কীট প্রবেশ করিতে দেখিয়া চুপ করিয়া থাকাও অপরাধ।”
পরিশেষে যদি আমরা নজরুলের দার্শনিক ধারনা গুলিকে একত্রে নিয়ে আলোচনা করি,তাহলে দেখবো তিনি সব সময় এক সহজ সরল শিক্ষার কথা বলেছেন। আর পাঠক্রমও হবে সহজ সরল।তিনি মনে করেন শিক্ষার ক্ষেত্রে এক পারস্পারিক সুসম্পর্ক সর্বদা থাকা উচিত।কারন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যৌথ প্রয়াসেই শিক্ষা হয়ে উঠবে জৈবিক অন্তর্নিহিত সত্ত্বার বর্হি:প্রকাশ।