’নামহীন গোত্রহীন’ গল্পের বিষয় স্বতন্ত্রতা
বাঙালি জাতির কাছে ১৯৭১ সালটা ছিল একটি পালাবদলের কাল। এসময় পশ্চিম পাকিস্থানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্থানে বাঙালি নিধনের কাজ শুরু করেছিল। বাঙালিরাও ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন মরণ লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল – যা বিশ্ববাসীর কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
একসময় বাঙালি যোদ্ধাদের ধরতে না পেরে খান সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী কেউই রক্ষা পায়নি সেই দিনগুলিতে। বহু পিতা-মাতাকে চোখের সামনে নিজের সন্তানের শেষ দশা দেখতে হয়েছিল। দীর্ঘ ন’মাস নৃশংস হত্যা চলার পর পাকিস্থানী সেনারা বাঙালি মুক্তিফৌজদের কাছে হার শিকার করলে পূর্ব পাকিস্থান পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
জীবনের বিনিময়ে যারা বাঙালিকে দিয়েছিল স্বাধীনতার স্বাদ, ব্যস্ততম জীবনে মানুষ আজ অচিরেই তাদের ভুলতে বসেছে। তবু শুনতে ভালো লাগে এই ভেবে যে, সেই কালপর্বে দাঁড়িয়ে যেসব বাঙালি সুধীজন আগুনঝরা সেই দিনগুলির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তাঁরা নিজের কলমের আঁচড়ে রেখেছেন কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন। হাসান আজিজুল হক সেরকমই একজন মননশীল স্রষ্টা, যিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে একের পর এক সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
বাংলা ছোটগল্পের জগতে হাসান আজিজুল হক এক অতি পরিচিত নাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক আজিজুল হকের জন্ম হয় ১৯৩৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলায়। তাঁর মতো সমাজসচেতন বাস্তববাদী লেখক খুব কমই চোখে পড়ে।
সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষ ও তাদের জীবনকথা, রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনাধারা তাঁর গল্পে বারবার আনাগোনা করেছে। ১৯৬০ সালে প্রথম গল্প ‘শকুন’ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কথাকার হিসেবে ‘আগুনপাখি’, ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ প্রভৃতি উপন্যাসের পাশাপাশি ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘রাঢ়-বঙ্গের গল্প’, ‘মা মেয়ের সংসার’-এর মতো আরও বেশকিছু গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলি তিনি লিখেছেন। আর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে খণ্ড-বিখণ্ড তথ্যগুলিকে একান্তভাবে নিজস্ব ধাঁচে কাহিনির রূপ দিয়ে হাসান আজিজুল হক প্রতিটি গ্রন্থের গল্পগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
আমাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত ‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্পগ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৭৫ সালে। সাতটি গল্পে সমন্বিত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত গ্রন্থটির গল্পগুলিতে মানুষের বিপর্যয়ের চরম দুর্দশার চিত্রটি অঙ্কন করা হয়েছে, দেখানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্থানী সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত আচরণকে। শুধু তাই নয়, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করলেও সাধারণ মানুষের হৃদয়যন্ত্রণার যে বিন্দুমাত্র প্রশমন ঘটেনি বরং নানান সমস্যার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে জীবনধারণ করাই দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল সেদিকটিও উঠে এসেছে হাসান আজিজুল হকের গল্পে। এজন্য ‘নামহীন গোত্রহীন’ গ্রন্থটির গল্পগুলিকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে –
এক. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কালপর্বের গল্প –‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’।
দুই. মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বের গল্প – ‘আটক’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘কেউ আসেনি’, ‘ফেরা’।
গ্রন্থটির নাম গল্প ‘নামহীন গোত্রহীন’। এ গল্পে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কালপর্বে পাকিস্থানী সৈনিকদের পৈশাচিকতার ভয়াল রূপটি আরও প্রকোটভাবে ধরা পড়েছে। যুদ্ধের ডামাডোলে বাড়ি ছাড়া বহু মানুষ নাম হারিয়ে গোত্র ভুলে কিছু সম্পর্কের টানে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে আসছিল। গল্পে বর্ণিত নামহীন পথচারী লোকটিও বিকেলের ট্রেন থেকে নেমে প্রাণটি হাতে নিয়ে আঁকাবাঁকা গলিপথে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরছিল। এসময় চোখের সামনে সে দেখেছে খান সৈনিকের ভয়ে সমস্ত রাস্তাঘাটের নিস্তব্ধতার চিত্র, যেখানে আলো জ্বলা তো দূরের কথা দু’পাশের ঘরগুলির বিরাট দরজা পর্যন্ত শক্ত করে বন্ধ করা ছিল – শুধু অন্ধকারের নৈঃশব্দ্য থেকে উঠে আসছিল খট খট শব্দ। মাঝে মাঝে বিজাতীয় কন্ঠে বিকট হাঁক ওঠার শব্দ সে শুনেছে, শুনেছে স্ত্রীলোকের গোঙানির আওয়াজ। জীবননাশের আশঙ্কায় গলিপথে যেতে যেতে সে আট-দশ জন মিলে একজনকে গোল হয়ে ঘিরে থাকতে দেখেছে। এসময় তাদের মধ্যে যে প্রশ্ন-উত্তরের পালা চলছিল গল্পকার সুন্দরভাবে তা গল্পে পরিবেশন করেছেন – “তুমারা ঘর কাঁহা ?’ সে চুপ করে আছে। ‘জয়বাংলা কাঁহা হ্যাঁয় ?’ লোকটা কোনো কথা বলছে না। একজন তার মুখে প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসাল। কালো প্যান্ট পরা লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ‘শালা তুমকো গোলি করেগা’। ‘আভি করো’—উঠে বসে মুখ মুছতে মুছতে সে বলে। ‘তুম মুক্তিফৌজ নেহি হো শালা, বাঙালি কুত্তা ? শালা মুজিবকা পূজারি’। নেহি। ‘তুম হিন্দু নেহি হো ?’ নেহি। ‘লো ভাই, গুলি কর দো’। নেহি, নেহি, গুলি নেহি করেগা—।” কিন্তু লোকটির শেষ রক্ষা হয়নি। চোখের সামনে এসব দৃশ্য দেখে সে মাতালের মতো দুলতে দুলতে শেষ পর্যন্ত একটি একতলা বাড়ির বারান্দায় এসে স্ত্রী মমতা ও ছেলে শোভনকে হাক দিলেও কোনো সাড়া পায়নি। এঘর-ওঘর, রান্নাঘর, বাথরুম কোথাও তাদের না খুঁজে পেয়ে একসময় লোকটি উঠানের মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করে শোভনের পাঁজরের হাড়, হাতের অস্তি, হাঁটুর লম্বা নলি, শুকনো সাদা খটখটে পায়ের পাতা। দীর্ঘ চুলের রাশ, কোমল কন্ঠাস্থি, ছোটো ছোটো পাঁজরের হাড়, প্রশস্ত নিতম্বের হাড় ও একটি করোটি দেখে লোকটি মমতাকে সনাক্ত করে এবং এরপর দ্বিগুণ উৎসাহে মাটি খুঁড়তে থাকে যেন পৃথিবীর ভেতরের নাড়িভুড়িঁসুদ্ধ সে বের করে আনতে চায়।
গল্প বলার এমন বলিষ্ঠ ও গতিশীল ভঙ্গি খুব কম গল্পকারের লেখাতেই দেখা যায়। একেবারে সহজ সরল গদ্যে প্রাঞ্জল ভাষায় আজিজুল হক গল্পগুলির ঘটনাকে পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। তার প্রতিটি গল্পের এই ঘটনাকে এমনভাবে কার্যকারণ সূত্রে গেঁথে দিয়েছেন যেন মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শিকড় থেকে মনি-মুক্তোর মতো ভয়াল নৃশংসতার ছবি তথা মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চিত্রটি উঠে এসেছে – অনুভবী পাঠক একটু সচেতনভাবে গল্পগুলি পাঠ করলেই তা উপলব্ধি করতে পারবে। আসলে গল্পকার মুক্তিযুদ্ধের সমসাময়িক সমাজকে যে দৃস্টিভঙ্গিতে দেখেছেন, গ্রন্থটির গল্পগুলিতে ঠিক সেভাবেই তুলে ধরেছেন। আর এজন্যই গল্পে বর্ণিত ভূষণ, রামশরণ, আসফ আলি, আলেফ প্রমুখ মুক্তিফৌজ জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে এবং তারা গল্পের মধ্যে স্বাভাবিক ছন্দে নিজেদের মেলে ধরতে পেরেছে। স্বাভাবিকভাবেই অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে হাসান আজিজুল হকের ‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্পগ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যতম মুখদর্পণ হয়ে উঠেছে।
=========