শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২২ অপরাহ্ন

স্কুলজীবনে প্রিয় শিক্ষকদের স্মৃতি

শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান / ৪৩৬ সময়
আপডেট: মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০২৪

সৃষ্টিশীল ও সুন্দর মানুষ তৈরির সোপান হলো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সময়ের প্রয়োজনে জামালপুর জেলার মেলান্দহের ঐতিহ্যবাহী মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯৩৫ সালের প্রারম্ভে জুনিয়র মাদ্রাসা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তখন প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল মনির উদ্দিন জরিমন্নেছা জুনিয়র মাদ্রাসা (এম জে জুনিয়র মাদ্রাসা)।

মাদ্রাসাটির দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মাহমুদপুরের মিঞা বাড়ির মনির উদ্দিন মিঞাসহ স্থানীয় কয়েকজন বিদ্বোৎসাহী, সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি মুখ্য ভূমিকা রাখেন বলে জানা যায়। ১৯৬২ সালের প্রারম্ভে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন হয়ে জুনিয়র স্কুল ও পরে ১৯৬৭ সালের প্রারম্ভে হাইস্কুলে উন্নীত হলে মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয় বলে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্যাডে লিখিত তারিখ এবং তথ্য সূত্রালোকে জানতে পারা যায় ।

আমরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সেই সময় এই অঞ্চলে হাইস্কুল খুব অপ্রতুল ছিল। এখনকার মতো এত বেশি হাইস্কুল না থাকায় সেই সময় মাহমুদপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের গ্রাম ও বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে মেধাবী ছাত্ররা মাহমুদপুর হাইস্কুলে ভর্তি হতো। আমি তিন মাইল দূরবর্তী খাশিমারা গ্রাম থেকে মাটির রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেতাম। আজ প্রায় ২৭-২৮ বছর আগের কথা। স্মৃতির পটে এখনো জ্বলজ্বল করছে মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের মধুর স্মৃতি।

সেই সময় এই স্কুলের অনেক সুনাম ছিল। বেশ কয়েকজন শিক্ষক খুব নামকরা ছিল। তাঁদের মধ্যে একজন স্যারের নাম সম্পূর্ণ আলাদাভাবে মনে আছে, তিনি হচ্ছেন মো. রকিবুল ইসলাম (মৃত্যূ. ০৪.০২.২০১৪) স্যার। তিনি আমাদের সময় মাহমুদপুর হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমাদের সময়কালের শিক্ষকগণ অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। দু-একজন বেঁচে আছেন মাত্র।

জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) কবিতার আবহনে বলা যেতে পারে সকল শিক্ষকই শিক্ষক হয় না, কেউ কেউ শিক্ষক হয়। রকিবুল স্যার তেমনই একজন শিক্ষক। স্যার আমাদের সাফল্য দেখে গর্ববোধ করতেন। কোনো শিক্ষকের সঙ্গে যদি তাঁর ছাত্রের ভাব হয়ে যায় সেই শিক্ষকের মৃত্যু হয় না। তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকেন শিক্ষার্থীর মাঝে। জীবনের নানান ক্ষণে জীবন্ত হয়ে ওঠেন তিনি।

এমনি একজন শিক্ষকের ছাত্র ছিলাম আমি। অতি সাধারণ বেশভূষার ও মায়াভরা চেহারার রকিবুল স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। অতি সাধারণ বাচনভঙ্গি। বেতনকে তিনি মায়না বলতেন। তাঁর কথায় কথায় মমতা মাখা, দরদ মাখা। অল্প দিনের মধ্যে আমাদের সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। একজন সাধারণ মানুষ কতটা আধুনিক হতে পারেন তার উদাহরণ তিনি। তাঁর চলায়, কথায় আমরা দেখেছি। আমরা শ্রেণিকক্ষে দেখতাম স্যার পড়ানোর সময় আমাদের মধ্যে বোধ নির্মাণ করতেন। পড়ানোর বিষয়টাকে যতদূর সম্ভব চিত্তাকর্ষকভাবে উপস্থাপন করতেন তিনি।

কোনো বিষয় পড়ানোর আগে তিনি সেটার ইতিহাস বলতেন। তিনি আমাদের তুমি বলে সম্বোধন করতেন। আমাদের নাম ধরে ডাকতেন, কখনো কখনো বাবা বলে ডাকতেন। তিনি আমাদের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করতেন।
একজন প্রকৃত শিক্ষক তাই করেন, ছাত্রদের লেখাপড়ার পথটি চিনিয়ে দেন, জানবার বাসনাকে উসকে দেন। ছাত্র শিক্ষক ভীতি কমিয়ে দেন, শিক্ষক ছাত্র দূরত্ব কমিয়ে দেন। আর জানবার প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেন ছাত্রের অন্তরে।
রকিবুল স্যারকে আমরা যতদিন পেয়েছি তিনি তাই করেছেন।

শিক্ষকতার পেশাকে তিনি জীবনের মহান ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। রকিবুল স্যারের সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। যা এক নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। রকিবুল স্যারের কাছে আমরা ছিলাম সন্তানতুল্য। স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা দিয়ে পাঠদানের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যত গড়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
রকিবুল স্যার অনেক গুণে গুণান্বিত ছিলেন। মনে পড়ে ছাত্রজীবনে স্যারের মাদারগঞ্জের ফাজিলপুরে গ্রামের বাড়িতে কয়েকবার গিয়েছি। সেই সময় আমি সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে এইচএসসি পড়ি। স্যারের সঙ্গে আমার পড়াশোনা, বইপত্র প্রভৃতি নিয়ে কথা হতো। তিনি কখনো না খেয়ে আসতে দেননি।

স্যারের গ্রামের বাড়ির সংলগ্ন তেঘরিয়া গ্রামে আমার খালার বাড়ি। খালার বাড়ি যাওয়ার সময় স্যারের বাড়ি হয়ে দু তিনবার গিয়েছি। আমার ছোট ভাই শাহ্ মোহাম্মদ আহসানুল কবীরকেও সঙ্গে নিয়েছিলাম। স্যার উচ্ছ্বাস ভরে বলতেন, ‘আমাকে তুমি এতো ভালোবাসো।’ আমাকে স্যার তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করে দিতেন। স্যারের ছেলেমেয়েরা খুব কৃতী।

মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন শিক্ষকের স্মৃতি আমাদের বোধের সঙ্গে মিশে রয়েছে। সব শিক্ষকের কথাই মনে পড়ে, তবে কেউ কেউ মনে একটু বেশিই দাগ কেটে গেছেন। স্কুলে খেলাধুলা, সংগীত, নাটক প্রভৃতি বিষয়ে অনুপ্রাণিত করতেন মো. খলিলুর রহমান (মৃত্যু. ১২.০৯.২০১০) স্যার। পড়াশোনার প্রতি অধিক ঝোঁক ছিল আমার। তাই এই বিষয়গুলো আমাকে খুব বেশি টানেনি। খলিল স্যার আমাদের শরীরচর্চা শিক্ষক ছিলেন। তিনি ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির ক্লাসে বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন।

মো. আব্দুল্লাহ মিয়া (মৃত্যূ. ২৪.০৮.২০২০) স্যার ছিলেন অসাধারণ ও অতুলনীয় প্রধান শিক্ষক। আমাদের তিনি ইংরেজি ক্লাস নিতেন। চমৎকারভাবে ইংরেজি কথা বলতেন। ইংরেজির উচ্চারণ শৈলী একসেন্ট ও ইনটোনেশন ছিল অসাধারণ। আমি কয়েকবার তাঁর মাদারগঞ্জের ঘুঘুমারী গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি।
আমাদের ধারণা সেই সময়ে তাঁর মতো শিক্ষক সারা জামালপুর জেলায় ছিল না। স্কুলের নিয়ম নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। তিনি ছাত্রদের খুব শাসন করতেন। কঠোর নিয়ম নীতি ও কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন তিনি। ছাত্ররা তাঁকে খুব ভয় পেত।
আমরা প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, নলছিয়া গ্রামের মো. হাবিবুর রহমান (মৃত্যু. ২৪.০৭.২০১৩) স্যারের কথা। স্যারের কাছে আমরা ক্লাসে গণিত ও জীববিজ্ঞান পড়তাম। স্কুল ছুটির শেষে তাঁর কাছে আমরা গণিত পড়েছি। এ জন্য তিনি টাকা নিতেন না।

মাহমুদপুর গ্রামের মো. মমতাজুর রহমান লাল মিয়া (জন্ম. ০১.০২.১৯৬০-মৃত্যু. ১৫.০৯.২০১৯) স্যারকে কখনো অভিমানী মনে হতো কিন্তু কোনোদিন আমাদের সাথে রাগ করতেন না।
সব সময় আমাদের পক্ষ নিতেন, ছাত্রদের খুব ভালোবাসতেন।
তিনি খুব মনোযোগের সাথে আমাদের রসায়ন, গণিত পড়াতেন। নানা টেকনিকে রসায়ন, গণিতের ভীতি দূর করতেন। তিনি আমাদের সঙ্গে অসম্ভব আন্তরিক ছিলেন। তিনি খুব নিবেদিত ছাত্রপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন।
আমাদের সময়ে মো. আলিম উদ্দিন (মৃত্যু. ২০.০৯.২০২২) স্যার, মো. আব্দুল লতিফ (মৃত্যু. ১৩.১২.২০১৮) স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন। চর মাহমুদপুর গ্রামের মো. আলিম উদ্দিন স্যার বাংলা কবিতা ও গদ্য পড়াতেন।

কাজাইকাটা গ্রামের মো. আব্দুল লতিফ স্যার ইংরেজি পড়াতেন। লতিফ স্যারের বাড়িতে আমরা ইংরেজি পড়তে যেতাম। স্যার অসুস্থ হয়ে বিএসএমএম ইউ-তে ভর্তি হলে তাঁকে কয়েকবার দেখতে গিয়েছি। হাসপাতালে স্যারের সঙ্গে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মো. রেজাউল আমিন রাজু ভাই ও স্যারের সহধর্মিণী ছিলেন।

আমাকে দেখে স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সেটাই ছিল আমার শেষ দেখা। সেই যাত্রায় তিনি আর সুস্থ দেহে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারেননি। বিএসএমইউ-তে ইন্তেকাল করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধেও মাহমুদপুর হাইস্কুলের ছাত্র ও শিক্ষক এবং প্রাক্তনীদের ভূমিকা ছিল। রকিবুল স্যার পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী পাঞ্জাবি মেজর করিম কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছিলেন বলে প্রবীণ এক শিক্ষকের নিকট জানতে পেয়েছি।
আমরা মনে করি, আমাদের সময় মাহমুদপুর হাইস্কুলে একটি উচ্ছ্বাস ছিল। এই স্কুলের অনেক কৃতী ছাত্র রয়েছে। যা গর্ব করার মতো। স্কুলের আগের সেই উচ্ছ্বাস এখন আর স্কুলে দেখতে পাই না।

এখন স্কুল ঘর অনেক উন্নীত হয়েছে, অবকাঠামো হয়েছে, বিল্ডিং হয়েছে। কিন্তু মো. রকিবুল ইসলাম স্যার, মো. আব্দুল্লাহ মিয়া স্যার, আব্দুল লতিফ স্যার, মো. খলিলুর রহমান স্যার, মো. হাবিবুর রহমান স্যার, মো. আলিম উদ্দিন সারের মতো খ্যাতিমান স্যারের অভাব বড়ো বোধ করি।

আসলে আমরা কী এই স্কুলের পূর্বসুরী তথা প্রাক্তনীদের যোগ্য উত্তরসুরি হতে পেরেছি? আমাদের মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় তাঁদের মতো ভালো স্যার সৃষ্টি হোক, ভালো মানুষ তৈরি হোক, কৃতী শিক্ষার্থী তৈরি হোক-এই প্রত্যাশা করি।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক। প্রাক্তনী : মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, জামালপুর, এসএসসি : ২০০১ ব্যাচ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিস্তারিত খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর