তাজরিন ফ্যাশনের ঘটনার এক যুগ
পোশাক শিল্পের আরেকটি কালো অধ্যায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। এই দিনে পোড়া লাশের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠেছিল আশুলিয়া।
দিনটি এলেই দুঃসহ স্মৃতি ভেসে উঠে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে বেঁচে ফেরা আহতদের মানসপটে। তাদের নাকে এখনও ভেসে বেড়ায় পোড়া লাশের গন্ধ। ভয়াবহ আগুনের কথা ভেবে এখনও আঁতকে ওঠেন ভুক্তভোগীরা।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) বিকেলে আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুরের পুড়ে যাওয়া তাজরীন ফ্যাশনে গিয়ে দেখা যায়, সেই ভবনটি পোড়া দাগ নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সেই দিনের বিভীষিকাময় ক্ষত চিহ্ন নিয়ে ভবনটির আশেপাশেই বসবাস করছেন আহত শ্রমিকরা। তারা একটু ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের প্রহর গুনছেন দিনের পর দিন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২ বছর আগে আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর এলাকার তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন আরও ৪ জন। মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রায় দুই শতাধিক শ্রমিক। কারখানাটিতে এক হাজার ১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন। তবে দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। মরদেহ শনাক্ত হওয়ায় ৫৮ জনকে পরিবার ও স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অন্যদের মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায় তাদের জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ঘটনার ১২ বছর অতিবাহিত হলেও নিশ্চিন্তপুরের সেই ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু একসময়ের কর্মঠ শ্রমিকরা এখন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। শারীরিক যন্ত্রণা, সংসারের অনটনের পাশাপাশি দোষীদের শাস্তি না পাওয়ার আক্ষেপে দিন কাটছে তাদের।
তাজরীন ফ্যাশনের তিন তলা থেকে লাফ দিয়ে নানা ধরনের শারিরীক সমস্যা নিয়ে দিনাতিপাত করছেন রেহেনা বেগম। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি তাজরীনের তিন তলায় স্যাম্পলে কাজ করতাম। আগুন লাগা দেখে আমি জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছি, নাকি আমাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে আমার মনে পড়ে না। তবে আমি তিনতলা থেকে পড়ে গিয়ে আমার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। আমার ঘারের হাড় ফেটে যায়। আমার বোন, বোনের স্বামী, আমার ভাগিনাসহ পরিবারের ৪ সদস্য তাজরীনের আগুনে অঙ্গার হয়েছে। শুধু আমি বেঁচে আছি। আমাকে আইএলও থেকে শুধু ৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো সুচিকিৎসা পাইনি। যে টাকা সহায়তা পেয়েছিলাম সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। এছাড়া একটি জমি বিক্রি করেও আমার চিকিৎসা করেছি। এখনও আমি অক্ষম। কোনো কাজ করতে পারি না। আমার সন্তানের লেখাপড়া করাতে পারি না, ভাল খাবার দিতে পারি না। অগ্নিকাণ্ডের সাথে জড়িতদের শাস্তি হলেও অন্তত স্বস্তি পেতাম। কিন্তু ঘটনার ১২ বছর অতিবাহিত হলেও এখনও কারও শাস্তি হলো না। আমরা সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন চাই। আমরা ভিক্ষা চাই না।
আহত শ্রমিক নাজমা আক্তার বলেন, আমাদের বিগত সরকার নানা সময়ে পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় নি। তবে নতুন শ্রম উপদেষ্টা আমাদের ডেকে নিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। খুব দ্রুত আমাদের জন্য কিছু একটা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। আমরা দ্রুত আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার দাবি জানাই।
তাজরীনের ৪ তলায় কাজ করতে রাজবানু। তিনিও শারিরীক নানা সমস্যায় ভুগছেন। দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে এখনও বসবাস করছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগটা পর্যন্ত দেওয়া হয় নি। আমরা চিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ্য না হলেও নতুন করে চাকরি নিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের চাকরি দেয়নি। গেটে গেলে তাজরীনের শ্রমিক বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা কোথাও চাকরি পাইনি। সে কারণে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। আমরা আগের মত বাঁচতে চাই, কাজ করে খেতে চাই। আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি জানাই, আমাদের যেন পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও শ্রম উপদেষ্টা আমাদের বিভিন্ন আশ্বাস দিয়েছেন।
এব্যাপারে বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অরবিন্দু বেপারী বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতের একটি বিভীষিকাময় দিন ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। এই দিনে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন ১১৭ জন ও আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক শ্রমিক। তাদের কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। যা দিয়েছে তা বিভিন্ন সংগঠন থেকে সহযোগিতা মাত্র। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। আমরা চাই প্রতিটা আহত শ্রমিক ও নিহতের পরিবার যেন তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায়। এছাড়া তাজরীনের পরিত্যক্ত ভবনটি সংস্কার করে দ্রুত শ্রমিকদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণের দাবি জানাই। যেখানে সকল শ্রমিকের বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে। সেই সাথে অগ্নিকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।