উত্তরা–খিলক্ষেতে ড্যান্ডিখোরদের উৎপাত! প্রাণঘাতী নেশায় ঝুঁকে পড়ছে পথশিশুরা
মনির হোসেন জীবন, বিশেষ সংবাদদাতা:
রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা থেকে খিলক্ষেত–বিশ্বরোড পর্যন্ত এখন ড্যান্ডিখোরদের উৎপাত ভয়াবহভাবে বেড়েছে। দুই অক্ষরের প্রাণঘাতী নেশার নাম ‘ড্যান্ডি’। জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত এই আঠা এখন অল্পবয়সী পথশিশুদের সস্তা নেশার উপকরণে পরিণত হয়েছে। বিকেল গড়াতেই উত্তরা, আজমপুর, বিমানবন্দর ও বিশ্বরোড এলাকায় শুরু হয় ড্যান্ডি নেশার ভয়ঙ্কর আসর। ফুটপাত, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার কিংবা রোড ডিভাইডারে বসে চলে এই নেশার সেশন।
সস্তা নেশা, সহজলভ্য ড্যান্ডি
‘ড্যান্ডি গাম’ কোনও প্রচলিত মাদক নয়, এটি মূলত সল্যুশন জাতীয় আঠা যা যন্ত্রাংশ মেরামত বা জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই আঠা ৫, ১০ বা ২০ টাকায় সহজেই হার্ডওয়্যার দোকানে পাওয়া যায়। পলিথিনে মুখ লাগিয়ে নিশ্বাস নিলেই নেশা—এভাবেই শিশুদের প্রতিদিন ঢলে পড়তে দেখা যায় ড্যান্ডির অন্ধকারে।
উত্তরায় ভয় বাড়াচ্ছে “ড্যান্ডিখোর গ্যাং”
স্থানীয়দের অভিযোগ, এখন এদের ‘ড্যান্ডিখোর গ্যাং’ নামে ডাকা হয়। তারা দলবদ্ধভাবে ফুটপাতে আড্ডা দেয়, প্রকাশ্যে নেশা করে, আর সুযোগ পেলেই পথচারীদের লক্ষ্য করে ছিনতাই বা মোবাইল চুরি করে। হাউজবিল্ডিং, আব্দুল্লাহপুর, আজমপুর, বিমানবন্দর থেকে নিকুঞ্জ পর্যন্ত এলাকাবাসীর কাছে তারা এক ধরনের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
“আমাদের কেউ নাই, তাই ড্যান্ডি খাই”
ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত রাব্বি, আরিফ ও সেলিম নামের তিন পথশিশু প্রতিবেদককে জানায়—
“আমাদের বাপ-মা নাই, রাস্তাতেই ঘুমাই। মন খারাপ থাকলে ড্যান্ডি খাই, কষ্ট কমে যায়।”
তারা জানায়, ড্যান্ডিখোরদের এখন নিজেদের দল আছে; কেউ বিপদে পড়লে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দলে আছে কিছু নারী সদস্যও।
পরিসংখ্যানে ভয়াবহ বাস্তবতা
সরকারি হিসাবে ঢাকা শহরে প্রায় ২ লাখ পথশিশু রয়েছে, আর ইউনিসেফের হিসাবে সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। এসব শিশুর বড় অংশ কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত। মাত্র ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী অনেক শিশুকেও পলিথিনে মুখ লাগিয়ে নেশা নিতে দেখা যায় রাস্তায়।
বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট সক্রিয়
সচেতন নাগরিক ও সমাজকর্মীদের মতে, ভাঙ্গারী ক্রেতাদের মধ্যেই এমন কিছু সিন্ডিকেট আছে যারা শিশুদের হাতে ড্যান্ডি ধরিয়ে দেয়। ভাসমান এসব শিশুরা খাদ্য, আশ্রয় ও ভালোবাসার অভাবে সহজেই মাদক বিক্রেতাদের কবলে পড়ে।
সামাজিক সংকটে পরিণত হচ্ছে ড্যান্ডিনেশা
নিকুঞ্জের বাসিন্দা সাংবাদিক ও সমাজকর্মী জাহিদ ইকবাল বলেন,
“একসময় উত্তরা-নিকুঞ্জ ছিল নিরাপদ ও পরিপাটি এলাকা। এখন ফুটপাতে ছোট ছোট শিশুরা পলিথিনে মুখ লাগিয়ে নেশা করছে—এটা সমাজের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা।”
বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব
সমাজকর্মী ও শিশু বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনটি পদক্ষেপ জরুরি—
১. ড্যান্ডি গাম বিক্রিতে লাইসেন্স ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ চালু করা
২. নেশাগ্রস্ত শিশুদের পুনর্বাসন, কাউন্সেলিং ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করা
৩. প্রশাসন, এনজিও ও স্থানীয় কমিউনিটির যৌথ সচেতনতা অভিযান শুরু করা
পুলিশের অবস্থান
ডিএমপি’র খিলক্ষেত থানার এক কর্মকর্তা জানান, অধিকাংশ ড্যান্ডিখোর অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। শিশু সংশোধনাগারেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। তবে উত্তরা বিভাগ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জরুরি প্রয়োজন মানবিক উদ্যোগ
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—
“এখনই যদি ড্যান্ডি নেশা নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, এটি শিগগিরই রাজধানীর অন্যান্য এলাকাতেও মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে।”
বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এনজিও ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে দ্রুত কার্যকর ও মানবিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন উত্তরা ও খিলক্ষেতের নাগরিকরা।